ব্ল্যাক হোল, সিঙ্গুলারিটি এবং পদার্থবিজ্ঞানের সংকট: এক মহাজাগতিক প্যারাডক্স

Insightful Ink-walk
0

১. ভূমিকা: কৃষ্ণগহ্বরের রহস্য ও সিঙ্গুলারিটির ধারণা

মহাবিশ্ব অগণিত রহস্যে পরিপূর্ণ, যার মধ্যে অন্যতম বিস্ময়কর এবং দুর্বোধ্য একটি ধারণা হলো কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল 1। নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মহাকাশের অতল গহ্বরের ছবি, যা সবকিছু গ্রাস করে নেয়। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে, কৃষ্ণগহ্বর হলো মহাকাশের এমন একটি অঞ্চল যেখানে মহাকর্ষীয় টান এতই শক্তিশালী যে কোনো কিছুই, এমনকি আলো পর্যন্ত, সেখান থেকে বের হতে পারে না 2। এটি তৈরি হয় অত্যন্ত বেশি পরিমাণ ভর একটি অতি ক্ষুদ্র আয়তনে সংকুচিত হওয়ার ফলে 2

ব্ল্যাক হোল


এই কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে কী আছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের শেষ নেই। তত্ত্ব অনুযায়ী, কৃষ্ণগহ্বরের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে এক চরম অবস্থা, যাকে বলা হয় 'সিঙ্গুলারিটি' (Singularity) বা অদ্বৈত অবস্থান 2। ধারণা করা হয়, এটি এমন একটি বিন্দু যেখানে নক্ষত্রের সমস্ত ভর কেন্দ্রীভূত হয়ে অসীম ঘনত্ব (infinite density) এবং অসীম স্থান-কাল বক্রতা (infinite spacetime curvature) তৈরি করে 2

কিন্তু এই সিঙ্গুলারিটির ধারণা পদার্থবিজ্ঞানের জগতে এক গভীর সংকট বা প্যারাডক্সের জন্ম দিয়েছে। আমাদের জানা পদার্থবিজ্ঞানের দুটি প্রধান স্তম্ভ—আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, যা মহাকর্ষ এবং বৃহৎ স্কেলের মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করে, এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, যা অতি ক্ষুদ্র কণা ও শক্তির জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে—উভয় তত্ত্বই সিঙ্গুলারিটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয় 5। এই দুই তত্ত্ব সিঙ্গুলারিটির চরম অবস্থায় পরস্পরবিরোধী ফলাফল দেয়।

এই পরিস্থিতি নির্দেশ করে যে সিঙ্গুলারিটি কেবল কৃষ্ণগহ্বরের একটি অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য নয়, বরং এটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দুটি মৌলিক তত্ত্বের মধ্যেকার গভীর দ্বন্দ্ব এবং আমাদের বর্তমান জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার প্রতীক। এটি মহাবিশ্বের চরম অবস্থা বোঝার ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ। সাধারণ আপেক্ষিকতা কৃষ্ণগহ্বর এবং তার কেন্দ্রে সিঙ্গুলারিটির ভবিষ্যদ্বাণী করে 2, কিন্তু সিঙ্গুলারিটির অবস্থাটি এতই ক্ষুদ্র যে তা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আওতায় পড়ে 11। যেহেতু এই দুই তত্ত্ব এখানে একসাথে কাজ করে না 8, সিঙ্গুলারিটি হয়ে ওঠে এই দুই মহান তত্ত্বের সংযোগস্থলে এক গভীর তাত্ত্বিক সংকট। এই প্যারাডক্স সমাধানের জন্য এবং সিঙ্গুলারিটির প্রকৃত রূপ বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন একটি নতুন, আরও মৌলিক তত্ত্বের প্রয়োজন, যা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি (Quantum Gravity) নামে পরিচিত 8

এই প্রতিবেদনে আমরা সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে কৃষ্ণগহ্বরের জন্ম, সিঙ্গুলারিটির ধারণা, এর ফলে সৃষ্ট প্যারাডক্স এবং পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করব। সবশেষে, আমরা দেখব কীভাবে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি এই মহাজাগতিক রহস্য সমাধানের আশা জাগাচ্ছে।

২. মহাকর্ষ যখন স্থান-কাল বাঁকায়: কৃষ্ণগহ্বরের জন্ম

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মাধ্যমে মহাকর্ষ সম্পর্কে আমাদের ধারণায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন 16। আইজ্যাক নিউটন মহাকর্ষকে দুটি বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল একটি আকর্ষণ বল হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন 16। কিন্তু আইনস্টাইন দেখালেন, মহাকর্ষ আসলে কোনো বল নয়, বরং এটি হলো স্থান-কালের (Spacetime) জ্যামিতিক বক্রতার ফল 2

আইনস্টাইনের তত্ত্বানুযায়ী, স্থান এবং কাল পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একসাথে মিলে একটি চতুর্মাত্রিক 'স্থান-কালের চাদর' তৈরি করে। এই চাদরের ওপর যখন কোনো ভর বা শক্তি স্থাপন করা হয়, তখন সেটি তার চারপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয় 2। একটি বহুল ব্যবহৃত উপমা হলো, একটি টানটান করে পাতা কাপড়ের ওপর একটি ভারী বল রাখলে যেমন কাপড়টি নিচু হয়ে যায় বা বেঁকে যায়, ঠিক তেমনি ভরযুক্ত বস্তু তার চারপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয় 2। বস্তুর ভর যত বেশি হয়, এই বক্রতাও তত বেশি হয়। এই বক্র পথেই অন্য বস্তুগুলো চলাচল করে, যা আমাদের কাছে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল হিসেবে প্রতিভাত হয়।

এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি ব্যাখ্যা করা যায়। নক্ষত্রগুলো তাদের জীবনকালে নিজেদের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়ার ফিউশন বা পারমাণবিক সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচণ্ড শক্তি উৎপাদন করে 3। এই শক্তি বাইরের দিকে একটি চাপ সৃষ্টি করে, যা নক্ষত্রের নিজস্ব ভরের কারণে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় ভেতরের টানের বিরুদ্ধে ভারসাম্য রক্ষা করে এবং নক্ষত্রটিকে স্থিতিশীল রাখে।

কিন্তু যখন একটি বিশাল নক্ষত্রের (সাধারণত যার ভর সূর্যের ভরের চেয়ে অনেক গুণ বেশি) পারমাণবিক জ্বালানি ফুরিয়ে যায়, তখন ভেতরের ফিউশন বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় 3। ফলে বাইরের দিকে সৃষ্ট চাপ আর মহাকর্ষীয় টানকে বাধা দিতে পারে না। তখন নক্ষত্রটি তার নিজের প্রচণ্ড মহাকর্ষের প্রভাবে ভেতরের দিকে চুপসে যেতে শুরু করে। এই ঘটনাকে বলা হয় মহাকর্ষীয় পতন (Gravitational Collapse) 3

যদি নক্ষত্রটির অবশিষ্ট ভর যথেষ্ট বেশি হয় (একটি নির্দিষ্ট সীমা, যা টলম্যান-ওপেনহাইমার-ভোলকফ সীমা নামে পরিচিত, এর চেয়ে বেশি), তবে কোনো পরিচিত বলই—এমনকি পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে টিকিয়ে রাখা শক্তিশালী নিউক্লীয় বল বা নিউট্রন কণাগুলোর মধ্যেকার ডিজেনারেসি চাপও—এই পতনকে রুখতে পারে না 21। নক্ষত্রটি সংকুচিত হতে হতে একটি নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের (যা কার্ল শোয়ার্জশিল্ডের নামে শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ বা Schwarzschild Radius নামে পরিচিত) চেয়েও ছোট হয়ে যায় 7। এই অবস্থায় নক্ষত্রটি একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয় 2। শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধটি আসলে একটি কাল্পনিক গোলকের সীমানা, যাকে বলা হয় ঘটনা দিগন্ত (Event Horizon) 3। এই সীমানার ভেতরে মহাকর্ষীয় টান এতই প্রবল হয় যে সেখান থেকে কোনো কিছুই, এমনকি আলোও, বাইরে আসতে পারে না।

এভাবেই, সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে, কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হলো মহাকর্ষের চূড়ান্ত বিজয় এবং স্থান-কালের চরম বিকৃতির এক নাটকীয় পরিণতি 20। এটি দেখায় যে মহাকর্ষ কেবল গ্রহ-নক্ষত্রের গতি নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিই নয়, বরং এটি স্থান-কালের কাঠামোকে এমনভাবে বাঁকিয়ে দিতে পারে যা বস্তুর অস্তিত্বের চূড়ান্ত পরিণতি নির্ধারণ করে। বিশাল ভরের নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় পতন এবং তার ফলে স্থান-কালের জ্যামিতির এই চরম পরিবর্তন—এ সবই সাধারণ আপেক্ষিকতার মূলনীতি থেকে উদ্ভূত এক অনিবার্য ফলাফল।

৩. সিঙ্গুলারিটি কী? অসীমত্বের বিন্দু

সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব শুধু কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের কথাই বলে না, এটি কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে এক অত্যন্ত অদ্ভুত অবস্থারও ভবিষ্যদ্বাণী করে—সিঙ্গুলারিটি বা অদ্বৈত অবস্থান 6। সিঙ্গুলারিটি হলো স্থান-কালের এমন একটি বিন্দু বা অঞ্চল যেখানে আমাদের জানা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো, বিশেষ করে সাধারণ আপেক্ষিকতা নিজেই, ভেঙে পড়ে 5

সাধারণ আপেক্ষিকতার গাণিতিক সমীকরণ অনুসারে, কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে মহাকর্ষীয় পতনের ফলে নক্ষত্রের সমস্ত ভর একটি শূন্য আয়তনের বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয় 7। এই অবস্থাকেই সিঙ্গুলারিটি বলা হয়। এর দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:

১. অসীম ঘনত্ব (Infinite Density): ঘনত্ব হলো একক আয়তনে ভরের পরিমাণ ()। যদি একটি সসীম পরিমাণ ভর () একটি শূন্য আয়তনে () সংকুচিত হয়, তবে গাণিতিকভাবে তার ঘনত্ব অসীম () হয়ে যায় 7। সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুযায়ী, সিঙ্গুলারিটিতে ঠিক এটাই ঘটে।

২. অসীম স্থান-কাল বক্রতা (Infinite Spacetime Curvature): আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে, ভর ও শক্তি স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয় এবং এই বক্রতাই মহাকর্ষ হিসেবে অনুভূত হয় 2। যেখানে ঘনত্ব অসীম, সেখানে স্থান-কালের বক্রতাও অসীম হয়ে যায় 2। এর অর্থ হলো, সিঙ্গুলারিটির কাছাকাছি মহাকর্ষীয় টান অকল্পনীয়ভাবে শক্তিশালী, কার্যত অসীম। এই অসীম বক্রতার কারণেই সিঙ্গুলারিটির কাছাকাছি স্থান-কালের স্বাভাবিক জ্যামিতি ভেঙে পড়ে।

সিঙ্গুলারিটির ধারণাকে আরও স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য 'জিওডেসিক অসম্পূর্ণতা' (Geodesic Incompleteness) ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ 8। সাধারণ আপেক্ষিকতায়, কোনো বলের প্রভাব ছাড়া মুক্তভাবে পতনশীল কণা বা আলোকরশ্মি স্থান-কালে সবচেয়ে সরল বা সোজা পথ অনুসরণ করে, যাকে জিওডেসিক (Geodesic) বলা হয়। একটি স্থান-কালকে 'জিওডেসিক্যালি সম্পূর্ণ' বলা হয় যদি প্রতিটি জিওডেসিককে অসীম দূরত্ব বা সময় পর্যন্ত উভয় দিকে প্রসারিত করা যায়। কিন্তু সিঙ্গুলারিটির ক্ষেত্রে, তার দিকে ধাবমান কণা বা আলোর জিওডেসিক একটি নির্দিষ্ট সসীম সময়ে বা দূরত্বে গিয়ে হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায় 8। পথটি আর সামনে বাড়ানো সম্ভব হয় না, যেন স্থান-কাল নিজেই সেখানে শেষ হয়ে গেছে। এটাই জিওডেসিক অসম্পূর্ণতা, যা সিঙ্গুলারিটির একটি গাণিতিক নির্দেশক।

তবে এই 'অসীম' ঘনত্ব বা 'অসীম' বক্রতার ধারণাগুলো ভৌতভাবে অত্যন্ত সমস্যাযুক্ত। পদার্থবিজ্ঞানে যখন কোনো তত্ত্বের সমীকরণে অসীম রাশি চলে আসে, তখন তা সাধারণত ইঙ্গিত দেয় যে তত্ত্বটি ওই নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য নয় বা ভেঙে পড়েছে 24। সিঙ্গুলারিটির ক্ষেত্রেও তাই। সাধারণ আপেক্ষিকতা নিজেই তার সমীকরণের মাধ্যমে এমন এক পরিস্থিতির ভবিষ্যদ্বাণী করে যেখানে তত্ত্বটি আর কাজ করে না। এটি সাধারণ আপেক্ষিকতার কাঠামোর মধ্যেই তত্ত্বটির নিজস্ব সীমাবদ্ধতা এবং ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতার শেষ সীমাকে নির্দেশ করে। সিঙ্গুলারিটি তাই কেবল একটি গাণিতিক ধারণা নয়, এটি আমাদের বর্তমান মহাকর্ষ তত্ত্বের গভীরে থাকা একটি মৌলিক সমস্যার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে।

৪. পদার্থবিজ্ঞানের সংকট: সিঙ্গুলারিটি প্যারাডক্স

সিঙ্গুলারিটির ধারণাটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কেন্দ্রে এক গভীর প্যারাডক্স বা আপাত विरोधाभाসের জন্ম দিয়েছে। এই প্যারাডক্সের মূল কারণ হলো, সিঙ্গুলারিটির অবস্থায় পদার্থবিজ্ঞানের দুটি মৌলিক স্তম্ভ—সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা—একে অপরের সাথে তীব্র সংঘাতে লিপ্ত হয় এবং উভয়ই এককভাবে এই চরম অবস্থাকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয় 5

প্যারাডক্সের মূল প্রশ্নটি হলো: একটি শূন্য আয়তনের বিন্দুতে কীভাবে সসীম (এবং কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে বিশাল) ভর বা শক্তি থাকতে পারে?9 ঘনত্ব হলো ভর এবং আয়তনের অনুপাত। যদি আয়তন শূন্য হয়, তাহলে ঘনত্ব অসীম হয়ে যায়। কিন্তু ভৌত জগতে কি সত্যিই অসীম ঘনত্বের অস্তিত্ব সম্ভব? আমাদের পরিচিত স্থান, কাল এবং পদার্থের ধারণা এই চরম অবস্থায় ভেঙে পড়ে।

সাধারণ আপেক্ষিকতার সীমাবদ্ধতা: সাধারণ আপেক্ষিকতা মহাকর্ষকে স্থান-কালের বক্রতা হিসেবে বর্ণনা করে এবং এই তত্ত্ব অনুযায়ীই সিঙ্গুলারিটির উদ্ভব হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, এই তত্ত্বটি একটি ক্লাসিক্যাল বা চিরায়ত তত্ত্ব, যা স্থান-কালকে একটি মসৃণ ও অবিচ্ছিন্ন ক্ষেত্র হিসেবে ধরে নেয়। সিঙ্গুলারিটিতে স্থান-কালের বক্রতা অসীম হয়ে যাওয়ায় এই মসৃণতার ধারণা আর খাটে না 24। তত্ত্বের সমীকরণগুলো অসীম মান প্রদান করে, যা ভৌতভাবে অর্থহীন এবং নির্দেশ করে যে তত্ত্বটি নিজেই এই বিন্দুতে ভেঙে পড়েছে 25। সাধারণ আপেক্ষিকতা সিঙ্গুলারিটির 'ভেতরে' কী আছে বা সেখান থেকে কী হতে পারে, সে সম্পর্কে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সীমাবদ্ধতা: অন্যদিকে, সিঙ্গুলারিটি হলো একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র অঞ্চল, যেখানে দৈর্ঘ্য প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের (প্রায় মিটার) কাছাকাছি বা তার চেয়েও কম হতে পারে। এত ক্ষুদ্র স্কেলে বস্তুর আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অপরিহার্য। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, কণাগুলো একই সাথে নির্দিষ্ট অবস্থান ও ভরবেগে থাকতে পারে না (হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি) 11। কোনো কণাকে শূন্য আয়তনে আবদ্ধ করা এই নীতির পরিপন্থী 35। সুতরাং, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সিঙ্গুলারিটির মতো অসীম ঘনত্বের বিন্দুকে সমর্থন করে না। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রমিত কোয়ান্টাম বলবিদ্যা মহাকর্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে না 13। এটি স্থান-কালকে একটি স্থির, অপরিবর্তনশীল পটভূমি হিসেবে ধরে নেয়, যা সিঙ্গুলারিটির চরম মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে এবং স্থান-কালের অসীম বক্রতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

ভবিষ্যদ্বাণী করার অক্ষমতা (Breakdown of Predictability): যেহেতু মহাকর্ষ নিয়ন্ত্রণের জন্য সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং ক্ষুদ্র স্কেলের জন্য কোয়ান্টাম বলবিদ্যা—উভয় তত্ত্বই সিঙ্গুলারিটিতে ব্যর্থ হয়, তাই সেখানে ঠিক কী ঘটে, তা আমরা জানতে পারি না। পদার্থবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য হলো পর্যবেক্ষণ ও সূত্রের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ঘটনা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা 37। কিন্তু সিঙ্গুলারিটি এই ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতাকেই কেড়ে নেয় 12। সিঙ্গুলারিটির পরে কী হবে, বা সেখান থেকে কোনো তথ্য বাইরে আসতে পারে কিনা (যদিও ঘটনা দিগন্ত তা বাধা দেয়), তা আমাদের অজানা। কিছু তাত্ত্বিক মডেলে, যেমন চার্জযুক্ত বা ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে, কসি হরাইজন (Cauchy Horizon) নামে একটি সীমানার ধারণা আসে, যার বাইরে থেকে ভেতরের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হয় না, যা এই প্রেডিক্টেবিলিটির সমস্যাকে আরও প্রকট করে তোলে 37

এই প্যারাডক্স নির্দেশ করে যে সিঙ্গুলারিটি কেবল দুটি তত্ত্বের মধ্যেকার একটি গাণিতিক সংঘাত নয়, এটি পদার্থবিজ্ঞানের কার্যকারণ নীতি (Principle of Causality) এবং ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতার (Predictability) উপর একটি মৌলিক প্রশ্ন। এটি ইঙ্গিত দেয় যে মহাবিশ্বের চরম অবস্থায়—যেমন কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্র বা মহাবিশ্বের একেবারে শুরুতে—বাস্তবতার নিয়মগুলো আমাদের পরিচিত নিয়ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে এবং তা বোঝার জন্য আমাদের প্রয়োজন এক নতুন, আরও গভীর তত্ত্বের।

৫. বর্তমান তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা

কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে সিঙ্গুলারিটির ধারণাটি সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের একটি প্রত্যক্ষ গাণিতিক ফলাফল হলেও, এটি আসলে তত্ত্বটির নিজস্ব সীমাবদ্ধতারই একটি জোরালো ইঙ্গিত। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে দেখা গেছে, যখন কোনো প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় যেখানে তার সমীকরণগুলো অসীম বা অর্থহীন ফলাফল দেয়, তখন বুঝতে হবে তত্ত্বটি তার প্রয়োগের সীমার বাইরে চলে গেছে এবং একটি নতুন, আরও মৌলিক তত্ত্বের প্রয়োজন 24। সিঙ্গুলারিটির অসীম ঘনত্ব ও অসীম স্থান-কাল বক্রতা সাধারণ আপেক্ষিকতার ক্ষেত্রে ঠিক এমনই একটি পরিস্থিতি নির্দেশ করে।

সাধারণ আপেক্ষিকতা মহাবিশ্বের বৃহৎ স্কেলের কাঠামো, গ্রহ-নক্ষত্রের গতি এবং মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মতো ঘটনাগুলোকে অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে ব্যাখ্যা করেছে 39। এই তত্ত্বটি মূলত দুর্বল বা মাঝারি মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে এবং বৃহৎ দূরত্বে কাজ করার জন্য তৈরি। কিন্তু সিঙ্গুলারিটির পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন—এটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র (প্ল্যাঙ্ক স্কেলের কাছাকাছি) এবং এখানকার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র অকল্পনীয়ভাবে শক্তিশালী 32। এই চরম অবস্থায় সাধারণ আপেক্ষিকতার ভিত্তি—স্থান-কালের মসৃণ এবং অবিচ্ছিন্ন প্রকৃতি—ভেঙে পড়ে। তত্ত্বটি এই পরিস্থিতিতে তার ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে 30

সাধারণ আপেক্ষিকতার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতাগুলোর একটি হলো এটি কোয়ান্টাম প্রভাবকে অন্তর্ভুক্ত করে না 36। এটি একটি ক্লাসিক্যাল তত্ত্ব। কিন্তু সিঙ্গুলারিটির মতো অত্যন্ত ক্ষুদ্র স্কেলে এবং প্রচণ্ড শক্তির পরিবেশে কোয়ান্টাম প্রভাবগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে 8। মহাকর্ষ কীভাবে কোয়ান্টাম স্তরে কাজ করে, তা সাধারণ আপেক্ষিকতা ব্যাখ্যা করতে পারে না। এই কোয়ান্টাম প্রভাবগুলো উপেক্ষা করার কারণেই সম্ভবত সাধারণ আপেক্ষিকতা সিঙ্গুলারিটিতে গিয়ে অসীমতার জন্ম দেয়।

পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতির দিকে তাকালে আমরা একই ধরনের সীমাবদ্ধতা এবং তার উত্তরণের উদাহরণ দেখতে পাই। নিউটনের চিরায়ত বলবিদ্যা দৈনন্দিন জীবনের গতি এবং মহাকর্ষকে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করলেও, আলোর গতির কাছাকাছি বেগে বা পারমাণবিক স্তরে এটি ব্যর্থ হয় 33। এই সীমাবদ্ধতা থেকেই জন্ম নেয় যথাক্রমে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। একইভাবে, সাধারণ আপেক্ষিকতার সিঙ্গুলারিটিতে ব্যর্থতা নির্দেশ করে যে এটিও মহাকর্ষের চূড়ান্ত তত্ত্ব নয়। এটি সম্ভবত একটি বৃহত্তর, আরও মৌলিক তত্ত্বের একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত কার্যকর রূপ। সেই মৌলিক তত্ত্বটি হলো কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি, যা মহাকর্ষ এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে একীভূত করবে।

সুতরাং, সিঙ্গুলারিটিকে সাধারণ আপেক্ষিকতার একটি "ব্যর্থতা" হিসেবে না দেখে, একে একটি গুরুত্বপূর্ণ "নির্দেশক" হিসেবে গণ্য করা উচিত। এটি আমাদের স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে এবং কেন আমাদের বর্তমান মহাকর্ষ তত্ত্বটি অপর্যাপ্ত। এটি আমাদের জ্ঞানের সীমানা চিহ্নিত করে এবং কোয়ান্টাম ও মহাকর্ষকে একীভূত করার মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের পরবর্তী স্তরে উত্তরণের পথনির্দেশ করে। সিঙ্গুলারিটি তাই একটি সমস্যা হলেও, এটি আসলে নতুন এবং গভীরতর তত্ত্ব অনুসন্ধানের সবচেয়ে শক্তিশালী চালিকাশক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম।

৬. সমাধানের খোঁজে: কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি

সিঙ্গুলারিটি প্যারাডক্স এবং সাধারণ আপেক্ষিকতার সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে মহাবিশ্বের চরম অবস্থাগুলো বোঝার জন্য আমাদের একটি নতুন তত্ত্ব প্রয়োজন। এই তত্ত্বটিকে অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞানের দুটি সফলতম স্তম্ভ—সাধারণ আপেক্ষিকতা (যা বৃহৎ স্কেলে মহাকর্ষকে বর্ণনা করে) এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা (যা ক্ষুদ্র স্কেলে পদার্থ ও শক্তিকে বর্ণনা করে)—একীভূত করতে হবে 5। এই কাঙ্ক্ষিত তত্ত্বটিই হলো কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি (Quantum Gravity)।

কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির মূল লক্ষ্য হলো মহাকর্ষকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভাষায় বর্ণনা করা, অথবা স্থান-কালের নিজস্ব কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করা 36। বিজ্ঞানীরা আশা করেন যে, এমন একটি তত্ত্ব সিঙ্গুলারিটির অসীম ঘনত্ব এবং অসীম বক্রতার সমস্যা সমাধান করতে পারবে। কোয়ান্টাম প্রভাবগুলো বিবেচনায় আনলে, স্থান-কাল হয়তো আর অসীমভাবে সংকুচিত হতে পারবে না, যার ফলে সিঙ্গুলারিটির পরিবর্তে একটি সসীম, ভৌতভাবে অর্থপূর্ণ অবস্থা পাওয়া যাবে 8

কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির কোনো একক, সুপ্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব এখনো নেই। তবে কয়েকটি সম্ভাবনাময় ধারা নিয়ে গবেষণা চলছে। এদের মধ্যে প্রধান দুটি হলো:

১. স্ট্রিং থিওরি (String Theory): এই তত্ত্ব অনুসারে, প্রকৃতির মৌলিক উপাদানগুলো বিন্দুর মতো কণা নয়, বরং একমাত্রিক, কম্পনশীল 'স্ট্রিং' বা সুতো 41। এই স্ট্রিংগুলোর বিভিন্ন কম্পন ভিন্ন ভিন্ন কণা হিসেবে প্রকাশ পায়। স্ট্রিং থিওরির একটি আকর্ষণীয় দিক হলো, এটি মহাকর্ষকে (গ্র্যাভিটন নামক কণার মাধ্যমে) অন্য তিনটি মৌলিক বলের (বিদ্যুৎ-চুম্বকীয়, সবল ও দুর্বল নিউক্লীয়) সাথে একীভূত করার সম্ভাবনা দেখায়। ধারণা করা হয়, স্ট্রিং থিওরির কাঠামোয় সিঙ্গুলারিটির অসীমতা দূর হতে পারে এবং স্থান-কাল একটি মসৃণ, যদিও অত্যন্ত বাঁকানো, জ্যামিতি লাভ করতে পারে 8

২. লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি (Loop Quantum Gravity - LQG): এই তত্ত্বটি একটি ভিন্ন পথ অনুসরণ করে। এটি স্থান-কালকেই কোয়ান্টাইজড বা কণায়িত (quantized) বলে মনে করে 42। LQG অনুযায়ী, স্থান-কাল অবিচ্ছিন্ন নয়, বরং এটি ক্ষুদ্রতম, অবিভাজ্য এককের (কোয়ান্টা) বুননে গঠিত, যা 'স্পিন নেটওয়ার্ক' (spin network) বা 'স্পিন ফোম' (spin foam) নামে পরিচিত 42। স্থানের এই মৌলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে, কোনো কিছুকে অসীমভাবে সংকুচিত করে শূন্য আয়তনে আনা সম্ভব নয়। ফলে, LQG ভবিষ্যদ্বাণী করে যে সিঙ্গুলারিটি গঠিত হতে পারে না 10। এই তত্ত্ব অনুসারে, কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে সিঙ্গুলারিটির পরিবর্তে অত্যন্ত উচ্চ ঘনত্বের কিন্তু সসীম একটি অঞ্চল থাকে। একইভাবে, মহাবিশ্বের শুরুর বিগ ব্যাং সিঙ্গুলারিটিও এই তত্ত্বে একটি 'বিগ বাউন্স' (Big Bounce) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, যেখানে একটি সংকোচনশীল মহাবিশ্ব সর্বনিম্ন আয়তনে পৌঁছে আবার প্রসারিত হতে শুরু করে 42

এই তত্ত্বগুলো এখনো তাত্ত্বিক পর্যায়ে রয়েছে এবং এদের পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া অত্যন্ত কঠিন 38। স্ট্রিং থিওরির জন্য অতিরিক্ত মাত্রার প্রয়োজন হয় যা আমরা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারি না, আর লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি বা প্রযুক্তি আমাদের আয়ত্তের বাইরে।

তা সত্ত্বেও, কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির অনুসন্ধান কেবল সিঙ্গুলারিটির গাণিতিক সমস্যা সমাধানের একটি প্রচেষ্টা নয়। এটি আরও গভীর এক অনুসন্ধান—মহাবিশ্বের একেবারে মৌলিক গঠন, স্থান-কালের প্রকৃতি, পদার্থ ও শক্তির চূড়ান্ত উৎস সম্পর্কে জানার প্রচেষ্টা 46। সিঙ্গুলারিটি আমাদের যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে, তার মোকাবিলা করতে গিয়েই হয়তো আমরা মহাবিশ্বের সবচেয়ে গভীর রহস্যগুলোর সমাধান খুঁজে পাব। কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তাই শুধু একটি সমস্যার সমাধান নয়, এটি পদার্থবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের চাবিকাঠি হতে পারে।

৭. উপসংহার: জ্ঞানের বর্তমান সীমা ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে অবস্থিত সিঙ্গুলারিটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গভীর এবং চ্যালেঞ্জিং একটি ধারণা। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, যা মহাকর্ষকে স্থান-কালের বক্রতা হিসেবে বর্ণনা করে, অনিবার্যভাবে এই সিঙ্গুলারিটির ভবিষ্যদ্বাণী করে—এমন একটি বিন্দু যেখানে ঘনত্ব এবং স্থান-কালের বক্রতা অসীম হয়ে যায় 6। কিন্তু এই অসীমতার ধারণাটিই তত্ত্বটির নিজস্ব সীমাবদ্ধতা এবং চরম পরিস্থিতিতে তার ভেঙে পড়ার ইঙ্গিত দেয় 24

সিঙ্গুলারিটি একটি প্যারাডক্স তৈরি করে কারণ এটি পদার্থবিজ্ঞানের দুটি মৌলিক তত্ত্ব—বৃহৎ স্কেলের জন্য সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং ক্ষুদ্র স্কেলের জন্য কোয়ান্টাম বলবিদ্যা—এর মধ্যে একটি গভীর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে 5। উভয় তত্ত্বই এককভাবে সিঙ্গুলারিটির চরম অবস্থাকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে আমাদের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে 37

এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তত্ত্বের সন্ধান করছেন, যা মহাকর্ষ এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে একীভূত করবে 8। স্ট্রিং থিওরি এবং লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির মতো তত্ত্বগুলো এই দিকে সম্ভাবনাময় পদক্ষেপ 8। এই তত্ত্বগুলো আশা জাগায় যে, কোয়ান্টাম প্রভাব বিবেচনায় আনলে সিঙ্গুলারিটির অসীমতা দূর হবে এবং তার পরিবর্তে একটি সসীম ও ভৌতভাবে অর্থপূর্ণ চিত্র পাওয়া যাবে 15। লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি এমনকি বিগ ব্যাং সিঙ্গুলারিটিকে একটি 'বিগ বাউন্স' দিয়ে প্রতিস্থাপন করার ধারণা দেয় 42

যদিও কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির একটি সম্পূর্ণ এবং পরীক্ষিত তত্ত্ব এখনো আমাদের হাতে নেই, এই গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণগহ্বর পর্যবেক্ষণ, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের বিশ্লেষণ এবং আদি মহাবিশ্বের релиক বিকিরণ (যেমন কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড) অধ্যয়ন করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে হয়তো এই তত্ত্বগুলোর পরীক্ষামূলক যাচাই সম্ভব হবে 22

সিঙ্গুলারিটির রহস্য উন্মোচন করা কেবল একটি তাত্ত্বিক কৌতূহল নিবারণ নয়, এটি মহাবিশ্বের মৌলিক কার্যপ্রণালী, স্থান-কালের প্রকৃতি এবং বাস্তবতার একেবারে ভিত্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আরও গভীর ও সমৃদ্ধ করবে। জ্ঞানের বর্তমান সীমানায় দাঁড়িয়ে সিঙ্গুলারিটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জানার এখনো অনেক বাকি এবং এই অজানা পথের অনুসন্ধানই বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!